রাখাইনে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। চলতি বছর ধান চাষের ব্যাপক হ্রাস, বাণিজ্য অবরোধ ও মৎস্য চাষে বিধিনিষেধ অঞ্চলটিকে সংকটের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে, যা রাজ্যটির খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়াচ্ছে, বিশেষ করে চালের
উৎপাদনশীল খাত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুপস্থিতিতে দেশটির বাকি অংশ এবং প্রতিবেশীদের কাছ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল। সেখানকার অর্থনীতির পরিপূর্ণ পতন অবশ্যম্ভাবী। অদূর ভবিষ্যতে রাখাইনের বিদ্যমান অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে পুনরুদ্ধারের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বিচ্ছিন্ন রাখাইন পড়তে পারে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখে। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি নাগাদ রাখাইনের ৯৫ শতাংশ জনসংখ্যা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়বে। কারণও দিবালোকের মতো স্পষ্ট। ইউএনডিপির হিসাব বলছে, ২০২৫ সালের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ রাখাইনের খাদ্য উৎপাদন অঞ্চলটির চাহিদার মাত্র ২০ ভাগ পূরণে সমর্থ হবে।
বীজ ও সারের সংকট, বৈরী আবহাওয়া পরিস্থিতি এবং অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষজন (আইডিপি) অত্যধিক পরিমাণে বেড়ে যাওয়ায় অঞ্চলটির অভ্যন্তরীণ চাল উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে, কারণ ওইসব বাস্তুচ্যুত মানুষজন এখন আর চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত নয় এবং এটি ক্রমবর্ধমান সংঘাতেরও কারণ হয়ে উঠছে।
গত বছর নভেম্বরে রাখাইনে ‘অপারেশন ১০২৭’ তীব্রতর হওয়ার সময় থেকেই কৃষি খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে অঞ্চলটিতে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে এবং ২০২৫ সালের মাঝামাঝি নাগাদ দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। চলতি বছর ধান চাষের ব্যাপক হ্রাস, বাণিজ্য অবরোধ ও মৎস্য চাষে বিধিনিষেধ অঞ্চলটির অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে, যা রাখাইনের খাদ্য মূল্যস্ফীতি দ্রুত বাড়াচ্ছে, বিশেষ করে চালের। চাল যে এ অঞ্চলের প্রধান খাদ্যশস্য।
একদিকে রাখাইন অঞ্চলে ধান উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বাড়ছে। ১৮ ডিসেম্বর মিসরের রাজধানী কায়রোতে মালয়েশিয়ার উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী ড. জাম্বরি আবদুলের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানান, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ কয়েক শতাব্দীর বাসভূমি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার পর সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নতুন করে ৮০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
এছাড়া গত দেড় থেকে দুই বছরে প্রায় ৬০ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে ২৩ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.)। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭২ জন রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে রাখাইন। এ অর্থনৈতিক ও খাদ্য সংকট তীব্র হওয়া নিয়ে ইউএনডিপির চলতি বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, রাখাইনজুড়ে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সীমানা দিয়ে পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, আয়ের অনুপস্থিতি, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাওয়া এবং প্রয়োজনীয় পরিষেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অভাব সেখানকার এরই মধ্যে উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা জনজীবনকে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে নজিরবিহীন সংকটে ফেলে দেবে।
রাখাইনের জমি চাষের ধরন থেকে বোঝা যায় যে ২০২৪ সালে অঞ্চলটিতে ৯৭ হাজার টন চাল উৎপাদিত হবে, যা রাখাইনের মাত্র ২০ শতাংশ জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা পূরণ করবে। অথচ ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই ১ লাখ ৮৬ হাজার টন চাল প্রয়োজন পড়বে। বছর শেষে এ পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ লাখ ৭২ হাজার টনে। অথচ এ অঞ্চলটি ২০২৩ সালে উৎপাদন করেছিল ২ লাখ ৮২ হাজার টন চাল। তখন চাল উৎপাদন সেখানকার জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদার ৬০ শতাংশ পূরণ করেছিল। বাকি ৪০ শতাংশ দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সরবরাহ করে পূরণ করা হয়েছিল। কিন্তু গত বছরের নভেম্বরের শুরুতে অঞ্চলটিতে জারি করা অবরোধের প্রভাব খাদ্য উৎপাদনে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলেছে। এক্ষেত্রে রাখাইন অঞ্চলের বাইরে থেকে এনে এ ঘাটতি পূরণ করতে হবে। কিন্তু তা-ও কঠিন। কারণ সেখানে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত উভয় বাণিজ্যই এখন যুদ্ধের কারণে সীমিত হয়ে পড়েছে। আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ দেশীয় খাদ্য উৎপাদন চাহিদার শুধু ২০ শতাংশ পূরণ করবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। ফলে অচিরেই রাখাইন তীব্র দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হতে পারে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেখানকার প্রায় ২০ লাখ মানুষ অনাহারের মুখে পড়তে পারে।
উপগ্রহ চিত্রের ওপর ভিত্তি করে রাখাইন অঞ্চলে ইউএনডিপির ধান চাষের প্রাক্কলনের তথ্যমতে, বর্ষা মৌসুমে ২০১৭ সালে প্রায় ২৯০ একর জমিতে ধান উৎপাদন করা হয়। এর ঠিক পরের বছর তা কমে দাঁড়ায় প্রায় ২১০ একরে। মাঝের চার বছর ধান উৎপাদন ওঠা-নামার মধ্যে ছিল। সর্বশেষ ২০২৪ সালের বর্ষা মৌসুমে ধান চাষ হয় মাত্র ৫২ একরে। অথচ এর আগের বছর ধান চাষ করা জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৯০ একর।
যদিও শুষ্ক মৌসুমে ধান উৎপাদনের চিত্রে খুব স্বল্প মাত্রায় হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটেছে। ২০১৭ সালে এটি ছিল ১০ একরের কম, যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪০ একরের কাছাকাছি, সেখানে ২০২৪ সালে শুষ্ক মৌসুমে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় প্রায় ২০ একরের কাছাকাছি।
এদিকে রাখাইন রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি। বর্তমানে রাখাইনের ১৭টি টাউনশিপের মধ্যে ১১টিই আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সর্বশেষ রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের শেষ জান্তা ঘাঁটিটির নিয়ন্ত্রণ নেয় সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। এর ফলে মিয়ানমার-বাংলাদেশের ২৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের মিয়ানমার অংশের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিদ্রোহীরা। সুত্র:বণিক বার্তা
পাঠকের মতামত